Sunday, May 26, 2019

দোলের স্মৃতি

পাড়ার কৃষ্ণচূড়া গাছটার মতন বছরের এই সময়টাতে সকলের মন রঙিন হয়। অবহেলায় বেড়ে ওঠা গাছটা প্রতি মুহূর্তে জানান দেয় এখনো বসন্ত আসে আমাদের এই পোড়া দেশে। স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই দূর থেকে ডেকে ওঠে বোকা কোকিলটা। ছেলেবেলায় পড়ার ফাঁকে আমরাও ওই কোকিলের স্বরে ডাকতাম আর বোকা কোকিলটাও সাড়া দিত আরো জোরে।

এখন পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া দেখতে শহুরে হুজুগে মানুষ ছুটে যান পুরুলিয়ার গ্রাম গুলোতে। দামী ক্যামেরা সাথে নিয়ে। ফেসবুকের দেওয়াল লাল হয়ে ওঠে পলাশের রঙে। মন কতটা রঙিন হয় জানিনা, তবে বেশ একটা দেখনদারি লক্ষ করা যায়।

আমাদের এই অঞ্চলে আগে অসংখ্য জুটমিল ছিল। ফলে দিন আনা দিন খাওয়া দেহাতি লোকের বাস ছিল। চটের বস্তার গায়ে যে রঙ দিয়ে লেখা হত, সেই রঙ এই সময়টাতে জুটমিলের দেহাতি লোকেদের হাত ঘুরে চলে আসতো আমাদের কাছে। ওনারা ওই রঙ কখনোই বিক্রি করতেন না। সকলের সাথে ভাগ করে নিতেন স্বেচ্ছায়। দোলের পরেও ওই বাঁদূরে পাকারঙ আমাদের গায়ে লেগে খাকতো কমপক্ষে দিন পাঁচেক। আর হাতের চেটোতে কমপক্ষে পনেরোদিন। জুটমিলে শ্রমিক দের মধ্যে দেহাতি লোক ছাড়াও বেশ কিছু উড়িয়া লোকও ছিলেন তারাও দোল উৎসব পালন করতেন যত্নে তাদের উড়িয়া পট্টিতে। ওখানের গানের সুর ও তাল টাও বেশ মজার ছিল। বিকাল বেলা পালকি করে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ নিয়ে বেরোতেন ওরা। আনন্দময় হয়ে উঠত চারপাশ। সাধারন মানুষ সাধারন ছিলেন। খুব ছোট ছোট কাজেও সবাই আনন্দে মেতে উঠতেন।

দোল তখনো এতটা হোলি হয়ে যায় নি। পাড়ার হরিসভায় হরিনাম সংকীর্তন হত অষ্টপ্রহর। এখনো এটা বজায় আছে তবে জাঁকজমক কমেছে অনেক। দোলের পরে সাতদিন ধরে কীর্তন গান হত আর শেষের দুদিন যাত্রাপালা হত। প্রথমদিন কোলকাতা থেকে যাত্রাদল আসতো আর শেষদিন পাড়ার লোকেরা মিলেই যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করতেন। আমরা ছোটরা সাজঘরে উকি দিতাম। অতি সাধাসিধে মানুষ কি রকম ভাবে ভয়ংকর রাবন রাজায় সেজে উঠতেন দেখতাম অবাক চোখে। আসলে তখন তো ঘরে ঘরে টিভি ছিল না। সাজঘরে উকি দিয়েই একবার সীতাকে বিড়ি খেতে দেখেছিলাম। বিস্ময়টা ছিল মনের ভিতর বহুদিন।

দোলপূর্নিমার আগে র রাতে গঙ্গা থেকে জল সয়ে এসে শুরু হত হরিনাম গান। গঙ্গার ওপার থেকে দেখা যেত উত্তরপাড়ার দোল তলার আতশবাজি পোড়ানো।একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। পাড়ার হরিসভা থেকে প্রথম প্রথম গানের আওয়াজ পাওয়া গেলেও একটু রাত বাড়লে শুধুই শ্রীখোল আর খঞ্জনির আওয়াজ ভেসে আসতো কানে। চাঁদের আলোয় ভেসে যেত ঘর। আর তার সাথে মাঝে মাঝে শ্রীরাধা গোবিন্দ জয়ো ধ্বনি। একরাশ মায়া তৈরি হত মনের কোনে।

এই সময়টাতে, বেশ কিছুদিন ধরে ঝরে যাওয়া পাতা গুলো সংগ্রহ করে রাখতাম আমরা। সাথে ফেলে দেওয়া মিস্টির হাড়ি। নারকেল গাছের পাতা ও সুপুরি পাতার কদর ছিল সবথেকে বেশি।  ইস্কুল থেকে ফেরার পথে যে যেমন পারতো শুকনো পাতা জড়ো করতাম আমরা ন্যাড়াপোড়ার জন্য। আর বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হত আলু। আলুপোড়া খাওয়া হত খুব মজা করে। এখন এই শহরতলি তেও খুব একটা দেখতে পাই না। তবে কিছু কিছু জায়গায় এখনো হয় বলে শুনি। আমরা চ্যাঁচোর বলতাম।

এই দোল উৎসবের মধ্যে একটা সাম্যবাদ দেখতে পাই। আগের দিনের বাঁদূরে রঙ বা এখনকার সময়ের ভেষজ আবিরে রঙিন হওয়ার পর পাড়ার ডাকসাইটে দাদা ও সাইকেলের দোকানের মেকানিক সবাই সমান।  বেলা বাড়ার সাথে সাথে সবার গায়ের জামাই ইলেক্ট্রিকের তারে। ফ্যাকাসে রাস্তাতেও তখন রঙের কারুকাজ।

দোলের সকাল বেলা টা শুরু হত, বাড়ির গুরুজন দের পায়ে ফাগ দিয়ে। জলখাবার খেয়ে স্থানীয় বন্ধুরা মিলে আমরা রঙ খেলতাম। হ্যা সেই বাঁদূরে রঙ দিয়ে। আমরা কখনোই দেখার সুযোগ পাই নি যে রঙ মাখার পর আমাদের এই চাঁদ বদনটাকে কি রকম দেখায়। তবে রঙ খেলে বাড়ি ফিরলে প্রতি বছরই মা বলতো নাকি ভুতের মতন লাগছে।

এখন দোল খেলার থেকেও বিভিন্ন বিভঙ্গে নিজের ছবি তোলার হিরিক লক্ষ করি। নিজের ফেসবুকের দেওয়ালে ওই ছবি সাঁটানো না অব্ধি কারো যেন শান্তি নেই। তারপর পছন্দ হোক বা না হোক লাইকের কাউন্টিং। শো অফ টা বড্ড চোখে লাগে।

এই বিশেষ সময়ে বাজারে আসে বিভিন্ন রঙের মঠ ও ফুটকড়াই ও মুড়কি। আমাদের ছেলেবেলায় দোলের পরে রঙিন মঠ লেবুর জলে গুলে খাওয়ার মজা এখনকার প্রজন্ম ভাবতেই পারবে না। হ্যা অবশ্যই কাঁচের গ্লাসে।আসলে এখনকার এই চুড়ান্ত বিশ্বায়নের জুগে সব ভীষন সহজলভ্য।

মানুষের মন অনেক বেশি রঙিন ছিল। ভরসা ছিল, বিশ্বাস ছিল পাকা রঙের মতন গাঢ়। তাই সেই রঙ টাকে ফলাও করে বাহ্যিক করে তুলতে হত না। এখন এই সমাজের অন্তরের রঙ এতটাই ফ্যাকাসে, যে 'লাগে মাস্কারা দু চোখ আঁকতে। ক্লান্তির কালো রঙ কে ঢাকতে'।
সবাই দেওয়াল ভরিয়ে তুলে জানান দিতে চায় দেখ 'কি সুখে রয়েছি আমি'।

~ সৌমিক মুখোপাধ্যায়
~ ২১ শে মার্চ ২০১৯

No comments:

Post a Comment

দুঃসময়

সত্যি কি আমাদের কিছু আসে যায়? সন্ত্রাসে মরে সেনা মন্ত্রীরা করে হায় হায়। সত্যি কি আমাদের কিছু আসে যায়? মৃত সেনার ছবি খবরের পাতায় পাতায়। ...