Thursday, May 17, 2018

ভোর রাতের ছায়াছবি

ভোরের দিকেই ছায়াছবির মত ফুটে উঠত দৃশ্য গুলো। দৃশ্য না বলে ঘটনা বলাই মনে হয় ভাল। তখন দিবাকর ক্লাস নাইনে পড়ে। পরের দিন ইন্ডিয়া শ্রীলংকা ওয়ানডে। ফাইনাল ম্যাচ। ভোর রাতে দিবাকর দেখল সৌরভ এক রানের জন্য সেঞ্চুরি মিস করল। কিন্ত ইন্ডিয়া ম্যাচ জিতল। ঠিক সেটাই ঘটল পরের দিন ম্যাচে।

কিছুদিন পর দেখল দুর্গা পুজোর সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী জল থইথই। ঠিক সেটাই ঘটল সেবছর পুজোর দিন গুলোতে।

ঘটনা গুলো এলোমেলো ভাবে আসতো ভোর রাতেই। প্রথম দিকে তেমন পাত্তা দিত না। কিন্ত এই ভোর রাতের ছায়াছবি দেখাটা দিবাকরের অভ্যাসে পরিনত হল।

ওর নিজের যাতে সুবিধা হয় তেমন কিছু ঘটনা আগে থেকে দেখতে পেলে বরং ভালই হত। কিন্ত তা কখনই হয় নি। কতবার পরীক্ষার আগের রাতে শোবার সময় ভেবেছে যদি প্রশ্ন গুলো সামনে ধরা দেয়। না তা কোনোদিনও হয় নি।

লেখাপড়ায় অতি সাধারন ছাত্র। কোন মতে টেনেটুনে গ্রাজুয়েশনটা পাশ করল। তারপর সেলসের চাকরি জোটালো একটা কোম্পানিতে।

ভোররাতের এই ছায়াছবির কথা কখনো কাউকে বলে নি দিবাকর। কারন বললেও কেউ বিশ্বাসই করবে না এসব। আজগুবি বলে হেসে উড়িয়ে দেবে।

সেই যেদিন ফ্লাইওভার ভেংগে পড়ল, তার কিছুদিন আগেই দিবাকর দেখে ফেলেছিল সেই দৃশ্য। আফসোস হয় মাঝে মাঝে, যদি আগে থেকে সকলকে সাবধান করে দেওয়া যেতো।

বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারতের জয়, আয়লা ঝড়ের তাণ্ডবলীলা, পশ্চিমবঙ্গ এর রাজনৈতিক পালাবদলের ছবি দেখে ফেলেছিল ঘটনা ঘটার আগেই।

সংকোচে কাউকে কখনো বলতে পারে নি সারাজীবন অন্তর্মুখী স্বভাবের দিবাকর। আনন্দের ঘটনা দেখলে যেমন মজা পেত, তেমনি, দুঃখের কিছু ঘটনা ঘটতে দেখলে মন টা খুব ভারী হয় যেত। ভীষন অস্বস্তি হত। ভয়ানক কিছু দেখলে আর ঘুমাতে পারতো না। ভোর রাতে বিছানা ছেড়ে ঘরে পায়চারি করত।

সেদিন বিকাল থেকে অঝোর ধারায় বৃস্টি হচ্ছিল। তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়লো। ঘুম নেমে এল সহজেই।

শবযাত্রা চলেছে। হরিধ্বনি ভেসে আসছে। খই উড়ছে বাতাসে। উগ্র ধুপের গন্ধ ভেসে আসছে নাকে। পাড়ার লোকেরাই কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে চলেছে মড়াটাকে। পাড়ার কেউ মারা গেল নাকি? কৌতুহলে চোখ গেল মড়ার দিকে। ছোট খাটো ক্ষয়াটে চেহাড়া। চোখে তুলসীপাতা, নাকে তুলো, গলায় রজনীগন্ধার মালা। দিবাকর নিজের মুখটা দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল বিছানাতে। সারা শরীর ভিজে গেছে ঘামে।

সেই ভোরের ছায়াছবির পর আর কিছু কখনো দেখেনি দিবাকর।

সৌমিক মুখোপাধ্যায়
১৬ মে, ২০১৮। বুধবার।

নবনীড়

নবনীড়ে এসে একাকিত্বটা একদম চলে গেল বন্দনা দেবীর। স্বামীকে হারিয়ে ছিলেন বছর দশেক আগেই। এখানে এসে সমবয়সী কত জন একসাথে থাকা, আড্ডা, হইচই করে দিন কাটানো।

তিন বছর হল, ছেলে জয়দীপ রেখে গেছে এখানে। প্রথম প্রথম কয়েক মাস খবর নিতো। তারপর থেকে আর নেয় না। প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেয় আর তার নিজের পেনশনের টাকাটা তো আছেই।

আসলে জয়দীপ তো খুব ব্যস্ত, অফিসে কাজের অনেক চাপ। তার ওপর নিজের সংসার। সেখানে বন্দনা দেবীকে দেখার সময় কই?

বন্দনা দেবীও নবনীড়ে বেশ ভালই আছেন। অন্তত আগের থেকে। প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ লাগতো। সারাটাদিন মনমরা হয়ে থাকতেন। তারপর সবই সয়ে গেল।

হাতের কাজ খুব ভালই ছিল। ইস্কুলে হাতের কাজের শিক্ষিকা ছিলেন। এখানে অবসর সময়ে সেগুলোই শেখাতে শুরু করলেন ঘর সংসার হীন, অনাথ, স্বামী পরিত্বক্তা মেয়ে গুলোকে। ওরা বন্দনা দেবী কে মা বলে ডাকে। পরম যত্নআত্মি করে। উনিও ওদের বিপদে আপদে যতটা সম্ভব পাশে থাকার চেস্টা করেন। অনুপ্রানিত করেন সকলকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। সাবলম্বী হতে।

এই সত্তর বছর বয়সে এখন প্রতিটাদিন নতুন করে বাঁচার রসদ খুঁজে পান বন্দনা দেবী। পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্র জয়ন্তী, দোল যাত্রা, রথ যাত্রা, দুর্গাপূজা, বড়দিন সব কিছু তেই আনন্দটা চুটিয়ে উপভোগ করেন।

আপন সন্তানের মা ডাক বহুদিন না শোনার আক্ষেপ ঘুচিয়ে দেয় এই অনাথ, অনাত্মীয় মেয়ে গুলো। গতকাল মাদারস ডে তে ওরা আনন্দে মাতিয়ে রাখল সারাটাদিন।

গতকাল সারাদিন মোবাইল দেখার সময় পান নি বন্দনা দেবী। রাতে শোবার সময় মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলেন। না কোন মিসড কল দেখতে পেলেন না।


সৌমিক মুখোপাধ্যায়
১৪ মে, ২০১৮। সোমবার।

Monday, May 7, 2018

ইন্দ্রজাল

ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় এক সন্ধ্যায় পরিমল বাবা মায়ের হাত ধরে মহাজাতি সদনে গেছিল পি সি সরকার জুনিয়ারের ম্যাজিক শো দেখতে। ওই সন্ধ্যেটা পরিমলের জীবন টাই পালটে দিল। তার সব ধ্যান গিয়ে পড়ল ম্যাজিক এর দিকে। দিন রাত নাওয়া খাওয়া ভুলে ম্যাজিক নিয়ে পড়ে রইল পরিমল। লেখাপড়া চুলোয় গেলো। আর ইস্কুল থেকে বিতাড়িত হল বছর তিনেকের মধ্যেই।

বাবা একটা ছোট বেসরকারি অফিসে কাজ করতেন। মা সংসার সামলাতেন। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে নিত্য অশান্তি লেগেই ছিল। একমাত্র ছেলে পরিমল ম্যাজিক নিয়ে থাকলে ভবিষ্যতে পেট চলবে কি করে?

কিন্তু পরিমলের ম্যাজিকের হাত টা ভালই ছিল। যখন বছর কুড়ি বয়স, তখন থেকেই ছোট ছোট ইস্কুল থেকে ডাক পেতে লাগল ম্যাজিক শোয়ের।

কচিকাঁচা গুলোকে আনন্দ দিতে পারলে সমস্ত দুখ কস্ট ভুলে যেত। যেটুকু টাকা পেত, তা দিয়ে নতুন নতুন ম্যাজিকের সরঞ্জাম কিনতো।

এমনি করেই ইন্দ্রজাল পরিমলের জীবনে ক্রমশ জাল বিস্তার করতে লাগল।

মাস তিনেক আগে একটা বাচ্ছাদের ইস্কুলে ভ্যানিশের খেলাটা দেখানোর পর অনেক গুলো সরঞ্জাম খুজে পাচ্ছিল না। পয়সার লোভ নেই ঠিকই, কিন্তু কস্ট করে পয়সা জমিয়ে কেনা ম্যাজিকের সরঞ্জাম খোয়া গেলে কারই বা ভাল লাগে?

ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল পরের দুটো শোতেও। এবার এক সাথে চার খানা পায়রা উড়ে চলে গেল। কিছু যে একটা অতিপ্রাকৃত ঘটছে, তা পরিমল বুঝতে পারল।

আজ দুপুর বেলা ওর ম্যাজিক শো ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সেরিব্রাল পালসির ছোট্ট ছোট্ট স্পেশাল শিশুদের মাঝে। ফুলের মত শিশুগুলোকে দেখে পরিমলের বুকের ভিতর টা কেমন যেন মোচড় মারছিল।

গ্রিনরুমে গিয়ে ম্যাজিকের ড্রেসটা গায়ে চাপাতেই এক ঐশ্বরিক শক্তি ভর করল পরিমলের ভিতর।

স্টেজে উঠল। শিশু গুলোর কলকলানি শুনতে পাচ্ছে। টিচার রা আপ্রান চেস্টা করছেন ওদের শান্ত করে রাখতে।

ম্যাজিক স্টিক টা হাতে নিয়ে, বিশেষ ভংগিমায় ঘোরাতেই গোটা হল শান্ত হয়ে গেল। একটা আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে না। পাখার আওয়াজটাও প্রকট এখন। দেখল একে একে সবাই অচৈতন্য হয়ে পড়ছে।

পরিমল ভীষন ভয় পেয়ে গেল। কিছু কি ভুল হল? দরদর করে ঘামতে লাগলো। তার ম্যাজিকের পোশাক ভিজে গেলো।

কিছু সময় পরে পরিমল দেখল ছোট্ট ছোট্ট ফুটফুটে ছেলে মেয়ে গুলির ঘুম ভাংছে। একটা অদ্ভুত আবেশ জড়িয়ে রয়েছে তাদের চোখে মুখে। তারা হাসছে, খেলছে আর পাঁচটা স্বাভাবিক শিশুর মতন। তাদের অভিভাবকেরাও উচ্ছসিত। করতালিতে ফেটে পড়ছে গোটা হল। আজ স্বয়ং পরমেশ্বর ভর করেছিলেন পরিমলের ইন্দ্রজালের খেলায়।

আজ পরিমলের ইন্দ্রজাল স্বার্থক।


সৌমিক মুখোপাধ্যায়

৭ মে, ২০১৮, সোমবার।

Friday, May 4, 2018

আনন্দ আশ্রম

বছরের এই সময়টাতে যে যেখানেই থাকুক না কেন, সবাই এসে উপস্থিত হয় পরিযায়ী পাখির মত শুধু মাত্র আমাদের বন্ধুত্বের টানে।

শীতের আমেজ গায়ে মেখে একটা দিন শুধুমাত্র ইস্কুলের বন্ধুদের সংগে কাটানো, গল্প, গান, আড্ডা এবং ছেলেবেলার দিন গুলোর স্মৃতি রোমন্থন। জীবনের দশ বারোটা বছর যারা কাটিয়েছিলাম এক সাথে।

'হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি
গেলেম কে কোথায়
আবার দেখা যদি হল সখা
প্রানের মাঝে আয়'

মফস্বলের ইস্কুল আরিয়াদহ কালাচাঁদ উচ্চ বিদ্যালয়ে ছোট্ট থেকে আমাদের বেড়ে ওঠা, মাধ্যমিক দেওয়া। অসাধারন সব মাস্টারমশাই দের সান্নিধ্য লাভ। এরপর কেউ বিজ্ঞান বিভাগে, কেউ বানিজ্য বিভাগে আবার কেউ বা কলা বিভাগে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্রান্তে। উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে কারো বা পাড়ি দেওয়া দূর রাজ্যে। এরপর জীবিকার্জনের জন্য সংগ্রাম।

এখন সকলেই চল্লিশ প্লাস।
কারো চোখে চালশে, কারো আবার উচ্চ রক্তচাপ, আবার কারো ডায়াবেটিস।

আগে যাকে দেখা যেত বাবড়ি চুলে, তার এখন মাথা জোড়া টাক। ভীষন ডানপিটে বিচ্ছু এখন শান্ত স্নিগ্ধ। আবার ভাল মানুষ সাত চড়ে রা না কাটা সুবোধ বালকটির এখন প্রখর বাগ্মীতা। কিচ্ছুটি মেলে না শুধু মাত্র মনটা ছাড়া।

বাঙালি তো তাই রাজনীতি, খেলাধুলা, সাহিত্য, সংগীত এই নিয়ে আড্ডায় সময় চলে যায় নিমেষের মধ্যে। মতের অমিল পাত্তা পায় না মনের মিলের কাছে।

এবছর, প্রস্তাব টা রেখেছিল অনিকেত।
একটু অন্য রকম ভাবে বাষিক আনন্দ টা উপভোগ করলে কেমন হয়?
যদি আনন্দ টাকে কয়েকগুন বাড়ানো যায়?
যদি আনন্দ টাকে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে?
এক দিনের জন্যও যদি হাসি ফোটে অবহেলিত শিশুদের মুখে?

সবাই এক কথায় মেনে নিল। ইস্কুলের বন্ধুদের হোয়াটস্যাপ এর গ্রুপে আলোচনা শুরু হল। একে বাস্তবায়িত করতেই হবে। আমাদের ক্যাপ্টেন অসিত, স্বাগত, সুমিত এরা ঝাঁপিয়ে পড়ল সকলের সম্মতি পেয়ে।

যোগাযোগ করা হল, সল্টলেকের প্রবর্তক মনোবিকাশ কেন্দ্রের সাথে। শিশু, কিশোর, যুবক, প্রৌঢ় মিলিয়ে ওদের সংখ্যা প্রায় জনা তিরিশ। সংঘের আর্থিক টানাটানি প্রবল। দু তিন জন জনদরদী মানুষ ও সাথে কয়েক জন কলেজ পড়ুয়ার স্বেচ্ছাশ্রমে চলে সংস্থাটি। কোন মতে বিভিন্ন লোকের অনুদানে চলা সংগঠনটিতে ওষুধপাতি ও নিত্যদিনের খরচ যেন নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা।

কথা হয়ে ছিল আগেই। সকাল থেকে প্রস্তুতি। শুধু পৌছানোর অপেক্ষা।

মনোবিকাশ কেন্দ্রে সকাল থেকেই আজ সাজো সাজো রব।
সকাল সকাল স্নান সেরে সবাই রেডি। ওদের অভ্যর্থনায় আমরা অভিভুত হয়ে গেলাম। আমাদের জন্য ওদের উপহার ছিল নিজেদের হাতে তৈরি ছোট ছোট সামগ্রী।

আমরাও ওদের সকলের জন্য নিয়ে গেছিলাম বই, রঙ পেন্সিল, খাতা, জামা কাপড়, চকোলেট, সাবান ও আরো কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। উপহার পেয়ে কখনো এত খুশি হতে কাউকে আমরা দেখি নি।

সকালের ব্রেকফাস্ট শেষ হতেই শুরু হল ওদের গান ও কবিতার আসর। কি সাবলীল। সকলেই আনন্দে উচ্ছসিত।

দুপুর বেলার খাবার আমরা নিজেরাই পরিবেশন করলাম। ওরা যত না খেল, আমোদিত হল ঢের বেশি। আমরা সকলে তখন এক পরিবার।

খাওয়ার পরে, বছর আঠারোর নিতাই তখন গলা ছেড়ে দুহাত প্রসারিত করে মনের আনন্দে গাইছে

"প্রান ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো
দাও প্রান...."

আমাদের সবার চোখে তখন জল

বাড়ি ফিরে যেতে মন চাইছিল না বিকাল বেলা। তবু সংসারী মানুষ আমরা, বিভিন্ন দায়ে আবদ্ধ, ফিরে এলাম মনোবিকাশ কেন্দ্র থেকে, শিঘ্রই ফিরে আসব ওদের মাঝে এই প্রত্যাশা নিয়ে।



সৌমিক মুখোপাধ্যায়
৪ মে, ২০১৮। শুক্রবার।

দুঃসময়

সত্যি কি আমাদের কিছু আসে যায়? সন্ত্রাসে মরে সেনা মন্ত্রীরা করে হায় হায়। সত্যি কি আমাদের কিছু আসে যায়? মৃত সেনার ছবি খবরের পাতায় পাতায়। ...