Friday, May 4, 2018

আনন্দ আশ্রম

বছরের এই সময়টাতে যে যেখানেই থাকুক না কেন, সবাই এসে উপস্থিত হয় পরিযায়ী পাখির মত শুধু মাত্র আমাদের বন্ধুত্বের টানে।

শীতের আমেজ গায়ে মেখে একটা দিন শুধুমাত্র ইস্কুলের বন্ধুদের সংগে কাটানো, গল্প, গান, আড্ডা এবং ছেলেবেলার দিন গুলোর স্মৃতি রোমন্থন। জীবনের দশ বারোটা বছর যারা কাটিয়েছিলাম এক সাথে।

'হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি
গেলেম কে কোথায়
আবার দেখা যদি হল সখা
প্রানের মাঝে আয়'

মফস্বলের ইস্কুল আরিয়াদহ কালাচাঁদ উচ্চ বিদ্যালয়ে ছোট্ট থেকে আমাদের বেড়ে ওঠা, মাধ্যমিক দেওয়া। অসাধারন সব মাস্টারমশাই দের সান্নিধ্য লাভ। এরপর কেউ বিজ্ঞান বিভাগে, কেউ বানিজ্য বিভাগে আবার কেউ বা কলা বিভাগে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্রান্তে। উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে কারো বা পাড়ি দেওয়া দূর রাজ্যে। এরপর জীবিকার্জনের জন্য সংগ্রাম।

এখন সকলেই চল্লিশ প্লাস।
কারো চোখে চালশে, কারো আবার উচ্চ রক্তচাপ, আবার কারো ডায়াবেটিস।

আগে যাকে দেখা যেত বাবড়ি চুলে, তার এখন মাথা জোড়া টাক। ভীষন ডানপিটে বিচ্ছু এখন শান্ত স্নিগ্ধ। আবার ভাল মানুষ সাত চড়ে রা না কাটা সুবোধ বালকটির এখন প্রখর বাগ্মীতা। কিচ্ছুটি মেলে না শুধু মাত্র মনটা ছাড়া।

বাঙালি তো তাই রাজনীতি, খেলাধুলা, সাহিত্য, সংগীত এই নিয়ে আড্ডায় সময় চলে যায় নিমেষের মধ্যে। মতের অমিল পাত্তা পায় না মনের মিলের কাছে।

এবছর, প্রস্তাব টা রেখেছিল অনিকেত।
একটু অন্য রকম ভাবে বাষিক আনন্দ টা উপভোগ করলে কেমন হয়?
যদি আনন্দ টাকে কয়েকগুন বাড়ানো যায়?
যদি আনন্দ টাকে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে?
এক দিনের জন্যও যদি হাসি ফোটে অবহেলিত শিশুদের মুখে?

সবাই এক কথায় মেনে নিল। ইস্কুলের বন্ধুদের হোয়াটস্যাপ এর গ্রুপে আলোচনা শুরু হল। একে বাস্তবায়িত করতেই হবে। আমাদের ক্যাপ্টেন অসিত, স্বাগত, সুমিত এরা ঝাঁপিয়ে পড়ল সকলের সম্মতি পেয়ে।

যোগাযোগ করা হল, সল্টলেকের প্রবর্তক মনোবিকাশ কেন্দ্রের সাথে। শিশু, কিশোর, যুবক, প্রৌঢ় মিলিয়ে ওদের সংখ্যা প্রায় জনা তিরিশ। সংঘের আর্থিক টানাটানি প্রবল। দু তিন জন জনদরদী মানুষ ও সাথে কয়েক জন কলেজ পড়ুয়ার স্বেচ্ছাশ্রমে চলে সংস্থাটি। কোন মতে বিভিন্ন লোকের অনুদানে চলা সংগঠনটিতে ওষুধপাতি ও নিত্যদিনের খরচ যেন নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা।

কথা হয়ে ছিল আগেই। সকাল থেকে প্রস্তুতি। শুধু পৌছানোর অপেক্ষা।

মনোবিকাশ কেন্দ্রে সকাল থেকেই আজ সাজো সাজো রব।
সকাল সকাল স্নান সেরে সবাই রেডি। ওদের অভ্যর্থনায় আমরা অভিভুত হয়ে গেলাম। আমাদের জন্য ওদের উপহার ছিল নিজেদের হাতে তৈরি ছোট ছোট সামগ্রী।

আমরাও ওদের সকলের জন্য নিয়ে গেছিলাম বই, রঙ পেন্সিল, খাতা, জামা কাপড়, চকোলেট, সাবান ও আরো কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। উপহার পেয়ে কখনো এত খুশি হতে কাউকে আমরা দেখি নি।

সকালের ব্রেকফাস্ট শেষ হতেই শুরু হল ওদের গান ও কবিতার আসর। কি সাবলীল। সকলেই আনন্দে উচ্ছসিত।

দুপুর বেলার খাবার আমরা নিজেরাই পরিবেশন করলাম। ওরা যত না খেল, আমোদিত হল ঢের বেশি। আমরা সকলে তখন এক পরিবার।

খাওয়ার পরে, বছর আঠারোর নিতাই তখন গলা ছেড়ে দুহাত প্রসারিত করে মনের আনন্দে গাইছে

"প্রান ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো
দাও প্রান...."

আমাদের সবার চোখে তখন জল

বাড়ি ফিরে যেতে মন চাইছিল না বিকাল বেলা। তবু সংসারী মানুষ আমরা, বিভিন্ন দায়ে আবদ্ধ, ফিরে এলাম মনোবিকাশ কেন্দ্র থেকে, শিঘ্রই ফিরে আসব ওদের মাঝে এই প্রত্যাশা নিয়ে।



সৌমিক মুখোপাধ্যায়
৪ মে, ২০১৮। শুক্রবার।

No comments:

Post a Comment

দুঃসময়

সত্যি কি আমাদের কিছু আসে যায়? সন্ত্রাসে মরে সেনা মন্ত্রীরা করে হায় হায়। সত্যি কি আমাদের কিছু আসে যায়? মৃত সেনার ছবি খবরের পাতায় পাতায়। ...