Sunday, July 29, 2018

মেকানিক

পল্টুদার গ্যারেজ সকলেই একডাকে চেনে। দেখতে দেখতে বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেল। মনে হয় যেন এই তো সেদিনের কথা। পাড়ার গ্যারাজে ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে কাজ শেখা। আগ্রহটা ছিল ছোট্ট থেকেই। কাজেই অল্প দিনের মধ্যে গাড়ির দক্ষ মেকানিক হয়ে উঠল পল্টু।

আগে চারচাকা গাড়ির অত রমরমা ছিল না। বেশির ভাগই এম্বাসেডর ও অল্প কিছু ফিয়াট, অনেক পরে এল মারুতি। আর এখন তো দম ফেলার সময় পায় না। হরেক কিসিমের গাড়ি। তবুও যেকোন গাড়ি একবার খুলেই নিমেষে বুঝে যেত সমস্যাটা ঠিক কোথায়। আর সেই মতন কাজ। পল্টু যেন সাক্ষাৎ বিশ্বকর্মা।

সকাল সাতটায় গ্যারেজ খুলে বন্ধ করতে করতে প্রতিদিন রাত এগারোটা বেজে যায়। ইদানিং তিনজন ছেলেকে কাজে লাগিয়েছে তাও সব্বাই চায় পল্টুদা একবার নিজে চেক করুক। তাতেই যেন সকলের শান্তি।

এক একদিন এক একটা গাড়ি বেশ ভোগায়। সমস্যা খুজে বের করতেই সময় চলে যায়। কিন্তু সারানো হয়ে গেলে এখনো এই বয়সেও বেশ রোমাঞ্চ জাগে।

মিউনিসিপালিটির এম্বুলেন্সটা গতকাল থেকে বেশ ভোগাচ্ছিল। গতকাল অনেক রাত অবধি দেখেও সুরাহা কিছুই হয় নি। তবে আজ সকালে এসেই প্রবলেম টা ধরতে পারল পল্টু। ড্রাইভার এসে নিয়ে যেতে পল্টু একগ্লাস চা খেয়ে আয়েস করে বিড়ি ধরাল। তিনটে ছেলে এখন কাজ করছে।

ইদানীং শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।সকাল থেকেই আজ কেমন যেন মাথা ধরা ভাব, ঘাড়ে ব্যাথা। বেলা হতে ব্যাথাটা বাড়তে লাগল। আজ গ্যারেজ না খুললেই ভাল হত। এই সব ভাবতে ভাবতেই শরীরটা একেবারে ছেড়ে দিল। টুল থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বিশাল শরীরটা।

তিনটে ছেলে দৌড়ে এসে শুইয়ে দিল মাটিতে। একজন তড়িঘড়ি করে সাইকেল নিয়ে ছুটল ডাক্তারখানায়। ডাক্তারবাবু দেখেই বললেন একটা ম্যাসিভ এটাক হয়ে গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে।

মিউনিসিপালিটির এম্বুলেন্সটা এল। যেটাকে কিছুক্ষন আগেই সুস্থ করে ফেরত পাঠিয়েছেন পল্টুদা। স্ট্রেচারে তুলে এম্বুলেন্স ছুটল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। প্রায় আধঘন্টার পথ।

সরবিট্রেটটা জিভের নিচে দেওয়াতে এখন কিছুটা সম্বিৎ ফিরেছে। একটু জল খেতে চাইলেন। হুটার বাজিয়ে এম্বুলেন্সটা ছুটে চলেছে। মিনিট পনেরো পথ যাওয়ার পর মাঝ রাস্তায় একটা শব্দ করে গাড়ির স্টার্টটা বন্ধ হয়ে গেল। ড্রাইভার অনেক চেষ্টা করেও স্টার্ট করতে পারছে না। সময় ছুটে চলেছে। ওদিকে স্ট্রেচারে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন বিশ্বকর্মা পল্টুদা।

ড্রাইভার ও হেল্পারের দম ছুটে যাওয়ার অবস্থা। বেগতিক দেখে গ্যারেজের ছেলেটাও আপ্রান চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু কোন চেষ্টাই কাজে আসছে না। গাড়ির ভিতর ছটফট করছে পল্টুদা। কিছু একটা করা দরকার।

এইসময় যে লোকটাকে সবথেকে বেশি দরকার ছিল, সেই এখন গাড়ির ভিতর স্ট্রেচারে শুয়ে অসহায়, প্রায় অচেতন।

হঠাৎ করে ড্রাইভারের চোখ গেল পল্টুদার দিকে। স্ট্রেচারে শুয়েই কালিঝুলি মাখা হাতটা কোনক্রমে তুলে কি যেন ইশারা করছে পল্টুদা। ড্রাইভার ছেলেটা এগিয়ে গেল সেইদিকে।

গাড়ি বন্ধ হওয়ার আওয়াজেই আন্দাজ করেছিলেন সমস্যাটা। হাতের ইশারায় ড্রাইভারকে কোনমতে বুঝিয়ে দিতেই গাড়ি আবার স্টার্ট নিল। অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

গ্যারেজের ছেলেটা পল্টুদার মুখের কাছে এসে জিজ্ঞেস করতে চাইল জল খাবে কিনা। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পেল না। মাথাটা হেলে পড়েছে বাঁ দিকে। সারা মুখে প্রশান্তির ছাপ স্পষ্ট। এখন যেন আর কোন যন্ত্রণাই নেই পল্টুদার। চোখের কোল বেয়ে নেমে এসেছে শুকিয়ে যাওয়া জলের ধারা। এই জলধারা নিশ্চিত ভাবেই আনন্দের। এম্বুলেন্সটা এখন হুটার বাজিয়ে ছুটে চলেছে হাইওয়ে দিয়ে তীর বেগে।

জুলাই ২৯, ২০১৮। রোববার।

Saturday, July 21, 2018

ভয়

গ্রামের ছোট্ট পরিসর থেকে উঠে আসা রবীন বাবু পড়াশুনায় বরাবরই মেধাবী ছিলেন। কিন্তু কলেজে পড়ার সময় থেকে জড়িয়ে পরলেন ছাত্র রাজনীতিতে। লেখাপড়া গেল চুলোয়। অভাবের সংসারে নিত্য অশান্তি লেগেই থাকত। কিন্তু রবীনের মাথায় তখন দিন বদলের নেশা।

অসম্ভব ভাল বাগ্মী ছিলেন। যে কোন সভা সমিতিতে রবীন বাবুর বক্তৃতা শোনার জন্য লোক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। যেমন ভঙ্গিমা তেমন গলার স্বর। সাথে প্রতিটি ঘটনার সাল তারিখের নিখুঁত বর্ণনা। মোহাবিষ্ট হয়ে শুনতেন সবাই।

নেতা থেকে মন্ত্রী হতে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি স্বাভাবিক কারনেই। জনপ্রিয়তাও যথেষ্ট। কাজের লোকও বটে।

ইদানীং ব্যস্ত তিনি আগত সমাবেশ নিয়ে। বছরের এই সময়টা রবীন বাবুদের নাওয়া খাওয়ার সময় থাকে না। সাংগঠনিক কাজকর্ম সামলানো থেকে বক্তব্য পেশ করা। ঝক্কি অনেক।

কিন্তু কয়েকদিন যাবত একটা অদ্ভুত সমস্যা অনুভব করছেন রবীন বাবু। ডাকসাইটে নেতা তিনি। কিন্তু বেশি ভিড় সহ্য করতে পারছেন না। কথার খেই হারিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝেই।
এদিকে সমাবেশের সময় এগিয়ে আসছে। চারদিকে পোস্টারে ছয়লাপ। মুখ্য বক্তা হিসাবে রবীন বাবুর নাম।

দেখতে দেখতে সমাবেশের দিন এসে গেলো। গ্রামগঞ্জ, শহরতলী থেকে কাতারে কাতারে লোক উপস্থিত হয়েছে সমাবেশে।

সবাই শ্লোগান দিচ্ছে। গান বাজছে। একটা উৎসবময় আবহ। সঞ্চালক ঘোষনা করলেন এবার মুখ্য বক্তার বক্তৃতার পালা। হাততালিতে ফেটে পড়ছে চারদিক। রবীন বাবুর হাতে মাইক্রোফোন তুলে দিলেন সঞ্চালক।

দরদর করে ঘাম বইছে রবীনবাবুর শরীর থেকে। কিচ্ছু শব্দ মনে আসছে না তার। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন দিগন্তব্যাপী জনসমুদ্রের দিকে। শ্লোগান উঠছে মুহুর্মুহু। সময় এগিয়ে চলেছে। কিন্তু একটা শব্দও এখনো উচ্চারিত হয়নি রবীন বাবুর মুখ থেকে। একটা অস্ফুট গোঙানি বেরিয়ে আসছে তার মুখ থেকে। গলা শুকিয়ে কাঠ। মাইক্রোফোনটা ছুড়ে ফেলে পালাতে চাইলেন মঞ্চ  থেকে। শ্লোগান পালটে পরিনত হল চিৎকার। রবীন বাবু পালাতে গিয়ে সজোরে পড়লেন মঞ্চের উপর থেকে।

স্ত্রী জয়ার ডাকে ঘুম ভাঙল। ঢকঢক করে বেশ কিছুটা জল খেলেন। ক্যালেন্ডারে চোখ গেল। এখনো চারদিন বাকি সমাবেশের। সকাল হতেই ছুটলেন ডাক্তারের কাছে। সব শুনে ডাক্তারবাবু বললেন গ্লসোফবিয়ায় সম্পূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন বেশ কিছু দিন। রবীনবাবু হতাশ হয়ে বসে রইলেন।


জুলাই ১৬, ২০১৮। সোমবার।

হেডলাইন

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সাইকেলে খবরের কাগজ বিলি করেই সংসার চালান বিশুদা। তারপর বেলা হলে টুকিটাকি কাজ ও লোকের ফাইফরমাশ খাটা।

অভাবের সংসারে আশার আলো মেয়ে বনানী। ছোট্ট থেকেই লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী মা মরা মেয়েটা। বাড়ির সব কাজ সামলে তারপর লেখাপড়া। ইস্কুলের দিদিমনিদের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা।

গতকাল দুপুরের পর থেকে দম ফেলার সময় পাননি বিশুদা। সারা এলাকা এসে ভেঙে পড়েছিল ওনার ঝুপড়ি ঘরে। মিষ্টিমুখ ও সাংবাদিক দের আবদার মেটাতেই কোথা থেকে রাত হয়ে গেল। বনানীর উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করার খবর টা বিশুদাকে দিয়েছিল পাড়ার লোকেরাই।

দুপুরে যখন রেজাল্ট বেরোনোর খবরটা এসে পৌছাল, তখন পাড়ায় হইহই কান্ড শুরু হয়ে গেল। টিভি চ্যানেলের ওবি ভ্যান, খবরেরকাগজ এর সাংবাদিক, এলাকার সাংসদ, বিধায়ক, পাড়ার নেতা, কেউ আসতে বাকি ছিল না। ঝুপড়ি ঘরে জায়গা হবে না বলে পাড়ার ক্লাবে সকলের বসার ব্যবস্থা হয়েছিল।

অনেক রাত হয়ে গেল শুতে। বনানীও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঝুপড়ির একফালি ঘর ফুল ও মিষ্টিতে ভরতি। দুটো মিষ্টি মুখে দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল বাবা ও মেয়ে।

আজ ভোরবেলা স্টেশনে কাগজ নিতে এসে চমকে উঠল বিশুদা। সব কাগজের প্রথম পাতায় বড় বড় করে ছবি ছাপা বনানী ও পাশে লাজুক লাজুক মুখের বিশুদার। আজ ওনারাই খবরের হেডলাইন। স্টেশনে সকাল থেকেই সাজো সাজো রব। কেমন যেন স্বপ্নের মতন লাগছিল।

সময় নষ্ট না করে রোজকার মতন সাইকেলে কাগজগুলো গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়ল বিলি করার উদ্দেশ্যে। রাস্তায় সবাই অবাক চোখে দেখতে লাগলো এক গরবিত বাবার দৃপ্ত ও উজ্জল সাইকেলে পদচালনা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মা-বাবার হাত ধরে ইস্কুলে যাচ্ছে। সকলের চোখ টিভি চ্যানেলের কল্যানে ইতিমধ্যেই বিখ্যাত হয়ে যাওয়া বিশুদার দিকে। এলাকায় আজ খবরের কাগজের চাহিদা অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক অনেক বেশি।

যত রকমের খবরের কাগজ আছে, সব একটা করে রাখলেন নিজেদের জন্য। এগুলো কোনোটাই আজ বিক্রীর জন্য নয়। কোনো খদ্দেরকে ফিরিয়ে দিতে মন চাইছিল না একেবারেই।

জুলাই ২১, ২০১৮। শনিবার।

Sunday, July 15, 2018

অপ্রাপ্তি

এক এক দিন এরকম হয়। দম ফেলার সময় পাওয়া যায় না। একটার পর একটা ডেড বডি আসতেই থাকে। আর সাথে শ্মশান যাত্রী ছেলে ছোকরার দল। তাও এখন সংখ্যা অনেক কমে গেছে কাচের গাড়ি আসার পরে। শহুরে লোকেদের লোকবলও এখন অনেক কম।

গরীব খেটে খাওয়া মানুষ মারা গেলে তবু অনেক লোক জন আসে। ময়নার চায়ের দোকানের বিক্রি বাটাও জমে যায় সেইসময়ে।

বয়স তো নেহাত কম হল না। গতবছর আধার কাডে নাম লেখানোর সময় আন্দাজেই বয়স বলেছিল ছত্রিশ।
ছোট থেকেই ডাকাবুকো স্বভাবের। মা কবে যে মরে ভুত হয়ে গেছে এখন আর মনে পড়ে না। বাবা রিক্সা চালাতো পাড়ায়। আর রাতে মদ খেয়ে বেশিরভাগ সময় রাস্তাতেই পড়ে থাকতো। ময়নার যখন বছর পনেরো বয়স, তখন ওর বাবাও পটল তুললো। বস্তির ঘরে একা ওই বয়সের মেয়ের থাকা যে কি ভয়ানক তা আর বলার নয়। লেখা পড়া তো আর শিখতে পারে নি, তাই গঙ্গার ধারে শ্মশানঘাটে চায়ের দোকান দিল। সেখানেও পাড়ার দাদারা দুবেলা এসে হুজ্জোতি করতো। সবই সয়ে গেছিল ময়নার।

বলরাম কে খুব ভাল লাগতো ওর। গ্রাম থেকে আসা ছেলে টা পাড়ার লেদ কারাখানায় কাজ করত। মাকে নিয়ে বস্তির একটা ভাড়া ঘরে থাকতো।

খুব শান্ত স্বভাবের ছেলে। ঠিক ওর বিপরীত। ওর দোকানে মাঝে মাঝেই চা খেতে আসতো। কিন্তু কখনো মুখ ফুটে বলতে পারে নি ভাল লাগার কথা।

বছর দুয়েক পর বলরাম এবং ওর মা চলে গেলো অন্য কোন জায়গায়।

কেবল টিভিতে মাঝে মাঝে সিনেমা দেখার সময় মনে পড়ে যায় বলরামের কথা। যত্ত সব পাগলামি। নিজের মনেই হাসে ময়না।

আজ সারাদিন প্রচুর ডেড বডি এসেছে। ময়নার চাও বিক্রি হয়েছে বেশ ভালই। এখন রাতও অনেক হল। এবার দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করতে হবে।

আবার একটা ডেড বডি আসছে। না ঝাঁপ যখন ফেলেই দিয়েছে আর খুলবে না ময়না এত রাতে। বস্তির ডেড বডি মনে হচ্ছে যেন। সাথে অনেক লোক। মনে হয় কোন অল্পবয়সী লোক মরেছে। খই উড়ছে বাতাসে। সচরাচর বস্তির লোকেরা যেরকম তারস্বরে হরিবোল বলে সেরকম বলছে না। শোকের ছায়া স্পষ্ট সকলের মধ্যে।

একটা বুড়ি হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে, তাকে সামলে রেখেছে কয়েক জন মিলে। বুড়ির একমাত্র অবলম্বন ছিল এই ছেলেটা। তিন দিনের জ্ব্ররেই চলে গেলো। সামনে আসতে লাইটপোস্টের আলোয় বলরামের বুড়ি মা কে চিনতে পারলো ময়না।

চুল্লি নিভতে নিভতে রাত একটা বেজে গেল। শেষ অবধি ময়না গঙ্গার ঘাটে বসেই কাটিয়ে দিল। শ্মশানযাত্রীরা সবাই চলে যাওয়ার পরেও অনেক রাত অবধি গঙ্গার ঘাটেই বসে রইল। অনেক রাতে ভেজা অস্থি তে জল ছিটিয়ে দুহাত তুলে প্রনাম করল ময়না। বুক চাপড়ে হাউহাউ করে কেঁদে ডাকাবুকো মেয়েটা।


সৌমিক মুখোপাধ্যায়।
৮ জুন, ২০১৮। শুক্রবার।

টেম্পল রান

স্মার্ট ফোন টা হাতে আসার পর থেকেই নিরুপম আচরন কেমন যেন বদলে যেতে লাগল। সদা আলাপী, মিশুকে স্বভাব টা পাল্টে যেতে লাগল দিনে দিনে।
এখন ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ এবং বিভিন্ন রকমের গেমস ডাউনলোড করে তাতেই মগ্ন হয়ে থাকে। বিশেষ করে অফিস যাওয়া ও আসার পথে বাসে বা ট্রেনে যেতে আসতে মোবাইলে গেমস খেলাটা একটা ওর নেশায় পরিনত হল।

মধ্য বয়স্ক নিরুপমের ইদানীং ব্লাড সুগার ধরা পরেছে। প্রেশারটাও স্বাভাবিকের থেকে বেশি। কায়িক পরিশ্রম একেবারেই হয় না বললেই চলে। সারাদিন অফিসের ডেস্কেই কেটে যায়।

কিছুদিন হল ওর স্মার্ট ফোনে  টেম্পল রান ও সাবওয়ে সার্ফার ডাউনলোড করেছে। সময় কাটানোর জন্য অবসর সময়ে এই গেমস গুলোই এখন ওর পছন্দের। আসক্তিও বাড়ছে দিনে দিনে।

সেদিন বাড়ি ফেরার পথে অন্যদিনের মত টেম্পলরান খেলছিল। সারাটাদিন বেশ ধকল গেছে অফিসে। গেমসে হাতটা এখন ওর ভালই চলে।খেলাটাতেও বেশ সড়গড় হয়ে উঠেছে।

স্কোর করছিল ভাল। দৈত্য টা তাড়া করছে, আর ও স্মার্ট ফোনের টাচ স্ক্রিনে আঙুল দিয়ে সুচারু ভাবে দৌড় করাচ্ছে। কখনো কখনো দৈত্যটা একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে পড়ছে কিন্তু নিরুপমের আঙুল ওকে নিয়ে চলেছে সেফ জোনে।

ট্রেন টা আজ খুব ভোগাচ্ছে। এক একটা সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকছে অনেকক্ষণ ধরে। ওদিকে গেমস এর স্কোর বেড়ে চলেছে হু হু করে। ওর আগের হাই স্কোরটাও ছাপিয়ে গেল আজ। পুরো মনটাই এখন ডুবে টেম্পলরানে। দৌড় দৌড় দৌড়। বেদম হওয়া মানা।

নিরুপমের পা টা কেমন যেন ভারি হয়ে আসছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দৈত্য টা যেন ঘাড়ের ওপর শ্বাস ফেলছে। আঙুল সরতে চাইছে না টাচ স্ক্রিনে।
নিরুপম দৌড়চ্ছে প্রানের ভয়ে। টাচ স্ক্রিনের উপর তার আঙুল এখন আর কোন কাজেই আসছে না। দৈত্যটার থাবা এখন ওর মাথার ওপর এসে পড়েছে।

অনেকক্ষন পড় সিগনাল পেয়ে ট্রেনটা ছাড়ল। ভোঁ এর আওয়াজে নিরুপমের তন্দ্রা ভাঙল। নিশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হতে চাইছিল না কিছুতেই। আশে পাশের সহযাত্রী রা অনেকটাই সাহায্য করল স্বাভাবিক হতে। কিন্তু অস্বস্তিটা কাটছে না। অব্যক্ত একটা ভয়ে বাড়ি ফিরে টেম্পলরান  এবং সাবওয়ে সার্ফার গেমস দুটো আনইন্সটল করে দিল নিরুপম।


সৌমিক মুখোপাধ্যায়
১৮ মে, ২০১৮। শুক্রবার।

ছেলেবেলার রথের মেলা ও ঝুলন যাত্রা

গতকাল অনেক বছর পর রথের মেলায় গেলাম। বারেবারে মনে পড়ছিল আমাদের ছেলেবেলার দিন গুলোর কথা। মনে হচ্ছিল যেন এই তো সেদিনের কথা।

আমদের ছেলেবেলার রথের মেলা মানেই ছিল পাপড় ভাজা, জিলিপি, আলুর চপ এবং অবশ্যই মাটির পুতুল কেনা। হরেক রকমের পুতুল - মাছউলি, ঝুড়ি মাথায় বউ, বাঁক কাঁধে মিস্ত্রী, সৈনিক, ট্রাফিক পুলিশ, রাধামাধব, একছাচের জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা এবং আরও কত্ত রকম। এই সবই কিনতাম আমরা ঝুলন সাজাবো বলে। এখনকার দিনের পুতুলের মত ফিনিশ ছিল না হয়ত, কিন্তু সেগুলো বানানো হত পরম যত্নে এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই।

কিছু পুতুল আসতো ঘুরনি থেকে। অসম্ভব সুন্দর। তাদের মধ্যে ঘাড় নাড়া বুড়োবুড়ি খুব বিখ্যাত ছিল। সব বাড়িতেই খুজলে একটা না একটা পাওয়া যেত। আর বিক্রি হত বিভিন্ন মহাপুরুষ দের পুতুল। তার মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় ছিলেন নেতাজী। তার পরে রবিঠাকুর, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ এনাদের পুতুল। এখন মেলায় এসব আর দেখা যায় না খুব একটা। এখন সব চাইনিজ পুতুলের রমরমা। ব্যাটারি চালিত।

আমাদের ছেলেবেলায়, রথের দড়ি টানার থেকে পুতুল কেনার আগ্রহ ছিল ঢের বেশি। কারন একটাই ঝুলন।

ঝুলনের আগে থেকে কাঠের গুড়ো জোগার করা, তাতে বিভিন্ন রং করা, কোনোটা সবুজ (মাঠের রঙ) , কোনোটা কালো (রাস্তার জন্য)। বালিও আনা হত রাস্তা বানানোর জন্য।

জোগাড় করা হত পুরানো কাপড়, ভাঙা ঈট পাহাড় বানানোর জন্য। পুরানো কাপড়ে মাটি লেপে ঈটের উপর চাপিয়ে পাহাড় বানানো হত। তার ফাঁকেফাঁকে লাগানো হত কামিনি গাছের ডাল পালা। আর তার ফাঁকে লুকিয়ে থাকতো প্লাস্টিক এর সৈনিক। সকলের হাতেই থাকত আগ্নেয়াস্ত্র। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বা শুয়ে।

পাহাড়ের সামনে বানানো হত গ্রাম, খেলার মাঠ, ইস্কুল, রাস্তা, হাসপাতাল। গ্রামের মোড়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ। আর গ্রামের এক কোনে গাছের নিচে স্থান হত রাধামাধবের। সব পরিকল্পনাটাই নির্ভর করত কার কাছে কেমন ধরনের পুতুল আছে তার ওপর আর নিজের নিজের সাজানোর দক্ষতার উপর।

বাড়ির বড়রা এই ঝুলন সাজানোতে খুব একটা সাহায্য করতেন না কখনো। যা সাজানো হত, সবটাই সাজাতাম আমরা নিজেরাই। শুধু রাতে যাতে সুন্দর লাগে দেখতে, তারজন্য আলোর ব্যবস্থা করে দিতেন বাড়ির বড়রা ছোট ছোট টুনি বালব দিয়ে।

এখন কাউকে আর দেখিনা ঝুলন সাজাতে। পুতুল কেনা তো অনেক দুরের কথা। আমার মনে হয় বিষয়টা কিন্তু দারুন ছিল। এখনকার ছোটরা মানসিকতায় অনেক অনেক বড় আমদের থেকে। তারা মাঠে না গিয়ে মোবাইলেই গেমস খেলে। আমরা নিত্য খেলাধুলো করা সত্যেও অনেক বড় বয়স অব্ধি জানতাম না ক্রিকেট, ফুটবলের বিভিন্ন পজিশন গুলোর নাম। এখনকার ছোটরা সব জানে।

বড্ড তাড়াতাড়ি পালটে গেলো সময়টা। পাল্টালাম আমরাও। চেষ্টা করে গেলাম আপ্রান পাল্টাতে। পারষ্পরিক সম্পর্ক এর গ্যাপ বাড়তে লাগল। আর আমরা জেনারেশন গ্যাপ কমাতে ছূটলাম। ঝুলন বিদায় নিল। বিদায় নিল মাটির পুতুল।

বিদায় নিল অনেক কিছু।
কোনটা পরে, কোনটা আগে।                             বয়স হচ্ছে বলেই বোধহয়।     
মাঝে মাঝে একলা লাগে।

~ সৌমিক মুখোপাধ্যায়

জুলাই ১৫, ২০১৮। রোববার।

দুঃসময়

সত্যি কি আমাদের কিছু আসে যায়? সন্ত্রাসে মরে সেনা মন্ত্রীরা করে হায় হায়। সত্যি কি আমাদের কিছু আসে যায়? মৃত সেনার ছবি খবরের পাতায় পাতায়। ...