Thursday, December 6, 2018

ছেলেবেলার শীত

আমাদের এখানে হেমন্ত কখন যে আসে ঠিক টের পাওয়া যায় না। দুগগা ঠাকুর বা কালি ঠাকুর জলে পড়লেই গা ছ্যাঁত ছ্যাঁত করতো।  ছেলেবেলায়, পুজোর রেশ মিটতেই মা কাকিমারা যখন আলমারি থেকে উল কাঁটা বের করতেন, তখন বোঝা যেত আর কিছু দিন বাদেই শীত আসছে। গ্রাফ পেপারে রকমারি ডিজাইন এঁকে সেগুলো অনায়াস দক্ষতায় দুটোমাত্র কাঁটার সাহায্যে রঙিন উল দিয়ে ফুটিয়ে তুলতেন বাড়ীর মা কাকিমারা। বাড়িতেই তৈরি হত সোয়েটার, মাফলার, টুপি, মোজা, গ্লাভস আরো কত কি।

দু তিন দিন অন্তর বুকের ছাতির মাপ নেওয়া হত। সাথে গলা ও পিঠেরও। আমরা অপেক্ষায় থাকতাম কবে বোনা শেষ হবে। আর পরদিনেই ইস্কুলে পরে যাব সেটা।

ইস্কুলে গিয়েও বন্ধুর মায়েরা কাছে ডেকে নিতেন নতুন ডিজাইন গুলো নিজেরা তুলে নিতে।

অনেকের বাড়িতে কুরুশের কাজও করা হত। এখন আর সেসব খুব একটা দেখতে পাই না। ছেলেবেলায় পুরানো সোয়েটার, যেগুলো ছোট হয়ে গেছে, তা থেকে উল খুলে নিয়ে বড় বড় উলের গোলা বানাতাম আমরা। সে এক বড় মজার ব্যাপার ছিল। সেই খোলা উল দিয়ে আবার তৈরি হত নতুন সোয়েটার, নতুন ডিজাইনের।

সত্যজিৎ বাবুর সিনেমায় এখনো দেখা যায় বাড়ির মহিলা দের উলের সোয়েটার বানানোর ছবি। সেলুলয়েডেই সাক্ষী থেকে গেছে।

কোন সান্টাক্লজ আমাদের ছেলেবেলায় শীত বয়ে আনতেন না। শীত বয়ে নিয়ে আসতেন জয়নগরের মোয়াওলা মাথার ডালা ভরে। ভরা দুপুরে হেঁকে যেতেন সুরেলা গলায়, জয়নগরের মোয়া, নলেন পাটালি গুড়।

কেক খাওয়ার রেওয়াজ বরাদ্দ ছিল বছরে একদিনই, বড়দিনে। অবধারিত ভাবে চলে আসত বড়ুয়া বেকারি। পেস্ট্রি খাওয়ার চল হয়েছে অনেক অনেক পরে।

আখের রসের গাড়ি ছিল, কিন্ত আমরা তার থেকেও বেশি মজা পেতাম দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে খেতে। মুখ ছড়ে গেলেও এর মজা ছিল ঢের বেশি। শীতের দুপুরের নরম রোদ্দুর পিঠে মেখে আখ খেতেও এখন আর খুব একটা কাউকে দেখি না।

ভরা শীতে সব পাড়া ম ম করতো নলেন গুড়, পাটালির গন্ধে। পিঠে, পুলি, পাটিসাপটা, রসবড়া আরো কত কি। এ বলে আমায় দেখ, তো ও বলে আমায়। এখন তো প্রায় সবই দোকানে বিক্রি হয়।

রবিবারের সকালে ধপধপে সাদা ফুলকো লুচি দিয়ে পয়রা গুড় খাওয়ার জন্যই আবার এখানে জন্মানোর ইচ্ছে জাগে মনে। অমৃতের স্বাদ কি রকম জানি না তবে সেটা নিশ্চিত এর থেকে ভাল হতেই পারে না।

শীতে ফি বছর সার্কাস ময়দানে আসতো অলিম্পিক সার্কাস। কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে অবাক বিস্ময়ে দেখতাম ট্রাপিজের খেলা। হাসিতে ভরিয়ে তুলতেন জোকার কাকুরা। অর্কেস্ট্রা বাজতো সার্কাসে। হ্যা ঠিকই পড়লেন, অর্কেস্ট্রা বাজতো। এখন তো প্রিরেকর্ড করা বাজনা বাজে। হাতি, বাঘ, সিংহ, জলহস্তীরাও ছিল সার্কাসের অঙ্গ। সেসব হারিয়েছে বহুদিন হল।

শীত পরলেই মনে পরে আমাদের পাড়ার মাঠে পুতুল নাচের আসর বসতো। তারা আসতো রকমারি পালা নিয়ে। প্রচার হত রিক্সা গাড়িতে চোঙা লাগিয়ে ও সাথে হাতে আঁকা পোস্টার। মাঠে চট বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা থাকতো। চলতো প্রায় দিন পনেরো। ভারি মজার ছিল সেই সময় গুলো।

আসতেন এক সাইকেল চালক দাদা। দিন সাতেকের জন্য। অবিরাম সাইকেল চালিয়ে যেতেন তিনি। মোটেই নামতেন না সাইকেল থেকে। গোল হয়ে ঘুরতেন মাঠ জুড়ে। দু এক দিনের মধ্যেই পাড়ার একজন হয়ে উঠতেন তিনি। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকতাম তার কুশলতা দেখে। আমাদের ছেলেবেলার হিরো হয়ে উঠতেন অল্পদিনেই। গায়ে পুরানো টিউব লাইট ভাঙতেন। আর শেষ দিনে মাটির নিচে কবরে যেতেন। অনেকক্ষন মাটির নিচে থাকতেন। সে সময় কেউ একটাও কথা বলতো না।পরে বের করে আনা হত অচৈতন্য অবস্থায়। সুস্থ করা হত দুধ রুটি দিয়ে। একাজে এগিয়ে আসতেন পাড়ার প্রায় সব মহিলারাই।

শীত মানেই কাঁধে গাঁটরি নিয়ে হাজির হতেন কাশ্মীরি শাল ওলা। যাদের সামর্থ্য ছিল, তারা কিনতেন। আমাদের কখনো কেনা হয়ে ওঠেনি।

যখন আমরা খুব ছোট, তখন একবার শহরে এসেছিল রাশিয়ান সার্কাস। এক্কেবারে অরিজিনাল। খুব সম্ভবত নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। ঠিক মনে নেই। অনেক বন্ধুরা গিয়ে দেখে এসেছিল।

শীত মানেই অবধারিত ভাবে চলে আসে, কফি খাওয়ার কথা। ভেতো বাঙালির কফি বিলাস। সাধ পুরন করতো নেসক্যাফে।

ইডেন গার্ডেনে ক্রিকেট খেলাটা তখন শীতেই হত শুধুমাত্র। সারা বছর জুড়ে ক্রিকেট খেলার চল ছিল না সে সময়। নরম রোদ গায়ে মেখে টেস্ট ক্রিকেট দেখার মাহাত্য এখন হারিয়েছে অনেকটাই।

তবে এখনো শীত আসে এ শহরে। অন্যভাবে। বেশিরভাগ ছেলেবেলার মজাই হারিয়ে গেছে চিরতরে। বয়স বাড়ছে। অল্পেই শীত ধরে এখন।

সৌমিক মুখোপাধ্যায়
ডিসেম্বর ৪, ২০১৮। মঙ্গলবার

দুঃসময়

সত্যি কি আমাদের কিছু আসে যায়? সন্ত্রাসে মরে সেনা মন্ত্রীরা করে হায় হায়। সত্যি কি আমাদের কিছু আসে যায়? মৃত সেনার ছবি খবরের পাতায় পাতায়। ...