Monday, April 30, 2018

বন্ধন

একমাত্র পুত্র অনিকের কাণ্ডকারখানা দেখে কল্যাণী ফিক করে হেসে ফেলল।

ভাল মুখোরচক চানাচুর, ডালমুট, এক প্যাকেট পপিন্স, দামি শাড়ি, সুন্দর থ্রিফোল্ড ছাতা, শৌখিন চটি আরও কত কিছু সব কল্যাণীর জন্য থরে থরে সাজিয়ে রাখছে অনিক। ওর স্ত্রী রিতাও খুব মনোযোগ সহকারে অনিক কে সাহায্য করছে। খুব মজা লাগছিল। ছোট্ট রিক দূরে মহানির্বাণ মঠের মাঠে খেলা করছে। আত্মীয়স্বজনরাও ইতিমধ্যে আসতে শুরু করেছে।

কিন্তু একি ! অনিক কি কাচা কলা সেদ্ধ খাওয়াবে না কি সিদ্ধ আতপ চালের সাথে আমাকে? সাথে আবার সিদ্ধ মাছ? ছ্যাঃ, এসব তো কল্যানী খেতে পছন্দ করে না। কস্ট পেল খুব।

আয়োজন ভালই করেছে অনিক। রান্নার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই।  মায়ের পছন্দ অনুযায়ী। এচোড়ের গুলি কাবাব, ছানার ডালনা, সাথে আনারসের চাটনি আর শেষ পাতে বাটারস্কচ আইসক্রিম। কিছুই এখন আর খাওয়া হবে না কল্যানীর।

আসলে শেষ দিকটায়য় শরীর ভাঙতে শুরু করেছিল কল্যাণীর। খাওয়াদাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা এল। খেতে খুবই ভাল বাসতো আগে। এখন নিত্যদিন নিত্যনতুন সমস্যা। ডাক্তার ভাজাভুজি, মিস্টি সব খাওয়া নিষেধ করে দিয়েছিল। তাই জীবনের প্রতি টান ক্রমশ চলে যাচ্ছিল। অথচ, অনিক ও রিতা যত্নেই রেখেছিল কল্যানীকে। উপরি পাওনা রিক সোনা।

দশদিন আগে ভোর রাতে কল্যাণী বুকে অসহ্য ব্যাথা অনুভব করতে লাগলো। সাথে নিশ্বাস নিতে কস্ট। আধঘণ্টা খুবই কস্ট পেল। ভোর বেলা অনিক ও রিতা যখন তাকে এম্বুলেন্স এ তুলল তখন দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। তারপর আর কিছুই মনে নেই কল্যানীর।

কেউ একজন, রিককে দুটো ডেয়ারি মিল্ক আর দুটো আংকেল চিপ্স এর প্যাকেট দিয়েছিল। ওর গল্প বলার ও খেলার সাথীর জন্য একটা করে প্যাকেট  রেখে এলো ঠাম্মির সুন্দর করে সাজানো ছবিটার সামনে। দুটোই যে কল্যাণীর খুব পছন্দের সেটা আর কেউ না জানুক রিক জানে।

বড় মায়ার এ সংসার। ছেড়ে যেতে মন চায়না একেবারেই। কিন্তু এবার যে তাকে যেতেই হবে সব বন্ধন ছিন্ন করে।

অনিক কাজে বসল। মঠে গীতা পাঠে ভেসে আসতে লাগল :

বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি । তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী ।। "


সৌমিক মুখোপাধ্যায়
২৯ এপ্রিল ২০১৮, রোববার।

পাগলি তোর জন্য

অসংখ্য মানুষের যাতায়াত এই পথ দিয়ে। কিন্তু কেউ ফিরেও তাকায় না বিশুর দিকে। বয়স প্রায় চল্লিশ। অবিন্যস্ত চুলে উকুনের পরিপাটি সংসার। আর চোখের কোলে পিচুটি। কত বছরের স্নান না করা শরীরে কালো কালো ছোপ। আস্তাকুড় থেকে যা পায় তাই কুড়িয়ে খেয়ে কাটিয়ে দেয়। কদম গাছ টার নিচেই বসে থাকে প্রায় সারাটাদিন।

দিন কয়েক হল, একটা অল্প বয়সি মেয়েও এসে জুটেছে এলাকায়। কতই বা বয়স হবে, পনেরো কি ষোল। চালচুলো হীন। কোথা থেকে যে এসে জুটেছে কে জানে? আস্তাকুড়ের পাশেই ঘুরঘুর করে, কিছু খাবার পাওয়ার আশায়। বিশু দেখলেই তেড়ে যায়, দাঁত খিচিয়ে ওঠে আর বিড়বিড় করে গালি দেয় পাগলিটাকে। ওর খাবারে যাতে ভাগ না বসাতে পারে সেই জন্য।

পাড়ার বয়স্ক মহিলারা মাঝে মাঝেই পুরানো জামা কাপড় দেয় মেয়েটিকে, কিন্তু ও গায়ে কিছু রাখতে চায় না। ওর লাজ লজ্জার বালাই নেই।

রাত বাড়লেই কিছু বখাটে ছেলে এসে ইদানিং আড্ডা বসায় ওই চত্তরে। খুব বেশি লোকজন রাতে এইদিকটাতে আসে না। সবাই সব জানে বোঝে কিন্তু ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না। সব দেখেও না দেখার ভান করে সবাই। অকথ্য গালি গালাজে সরগরম হয়ে ওঠে কদমতলার আশপাশ। বিশু পাগলা রোজই রাতে শুয়ে শুয়ে দেখে তারপর কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে।

সেদিন রাতে কিছুই খাওয়া জুটলো না বিশুর। আজ আর কোন গেরস্ত কিছু উচ্ছিষ্ট ফেলে যায়নি পাড়ার আস্তাকুড়ে। টিউবওয়েল থেকে জল খেয়েই শুয়ে ছিল। পাগলি টাও গিয়ে কিছুক্ষন খাবার খুজলো। কিন্তু কিছু না পেয়ে বসে রইল।
এক এক দিন এরকম যায়।

গোটা তিনেক বাইকের আওয়াজ এগিয়ে আসছে এদিকেই রোজকার মতন। বখাটে গুলো  বাইক থেকে নামল আর হইচই করতে লাগলো। পাগলি টাকে দেখে ওরা একটা প্যাকেট থেকে কিছু খাবার ছুড়ে দিল। আর বিশ্রী ভাবে হাসাহাসি করতে লাগল। খাবারটা পেয়ে হামলে পড়ে খেতে লাগল পাগলিটা।

পেটের সাথে সাথে এখন গাও জ্বলতে লাগলো বিশুর। হঠাত দেখলো নীল জামা পড়া একটা ছেলে পাগলি টার হাত ধরে টানছে বিশ্রী ভাবে। অদ্ভুত আওয়াজ করে হাসতে লাগলো পাগলিটা। না কি পাগলিটার কান্নার আওয়াজ। বিশু এত কিছু বোঝে না। কিন্তু এটুকু বুঝলো সভ্যতার সীমা ছাড়াতে চলেছে।

একটা আস্ত ইট পড়েছিল কদমগাছের গোড়ায় । বিশু ওটাকে হাতে তুলে দৌড়ে গিয়ে সজোরে মারল ছেলেটার মাথায়। নিমেষে রক্তে লাল হয়ে গেল জায়গাটা। এত অকস্মাৎ ঘটে গেল ঘটনাটা যে কিছু বোঝার আগেই বাকি ছেলেগুলো বাইক নিয়ে পালাল জায়গা ছেড়ে। নীল জামা ছেলেটার নিথর শরীর টা পড়ে রইল ওখানেই।

ওদের ফেলে যাওয়া খাবারের একটা প্যাকেট পড়ে ছিল কাছেই। বিশু কুড়িয়ে নিয়ে গোগ্রাসে খেতে শুরু করল।  পেটের জ্বালার সাথে গায়ের জ্বালাটাও জুড়িয়েছে এখন। পাগলি টাও খাবার টা প্রায় শেষ করে ফেলেছে ইতিমধ্যে।

জল ভরা চোখে ফেলফেল করে পাগলিটা তাকিয়ে রইল তার আস্তাকুড়ের প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে।

বাইক গুলো আবার ফিরে আসছে। বাইকের আলো তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো। কতদিন পর পেটভরে আজ খেতে পেল বিশু পাগলা।

সৌমিক মুখোপাধ্যায়
২৬ এপ্রিল ২০১৮

অযান্ত্রিক

দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই ধরমরিয়ে উঠে পড়লেন ব্রজেন বাবু। সকাল ৭ টা বেজে গেছে। ইস অনেক দেরি হয়ে গেল আজ। রাজ্য সরকারি কর্মচারী দের এখন নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। এই সময় টা মনোনয়ন পত্র দাখিলের সময়।

কোনমতে বাজার দোকান করে, স্নানে ঢুকলেন। স্নান সেরে ঠাকুর ঘরে ঝড়ের গতিতে প্রনাম সারলেন। বৈশাখ মাস হলেও এখনো তেমন গরম পড়েনি। স্ত্রী মিত্রা কে বললেন খাবার দিতে। যতটা সম্ভব অল্প করে। দশটার মধ্যে বিডিও অফিসে পৌছাতেই হবে। এখন হাজিরার খুব কড়াকড়ি।

বাড়ি থেকে অফিস যেতে বাসে পাক্কা এক ঘন্টা সময় লাগে। স্টান্ড থেকেই ওঠেন বলে অফিস টাইমেও বসার জায়গা পেতে অসুবিধা হয় না। আজও বসার জায়গা পেলেন যথারীতি।

কিছুটা পথ যেতেই, বাস টা হঠাত ঝাঁকুনি দিতে লাগল। বেশ একটু ঘুম ঘুম আসছিল। দিল ঘুমটা চটকে। ডেলি প্যাসেঞ্জাররা ইতিমধ্যে হইচই শুরু করে দিয়েছে। মিনিট তিনেক পর বাস টা একদম দাঁড়িয়ে গেল। ড্রাইভার বলল বাস আর যাবে না।
অসন্তোষ বাড়তে লাগল যাত্রীদের ভিতর।

ব্রজেন বাবু অধৈর্য হয়ে উঠলেন। কন্ডাকটর কে গালিগালাজ দিতে দিতে বললেন স্ট্যান্ড থেকে গাড়ি বেরোনোর সময় দেখে নিতে পারিস না? তাহলে এই রকম ভোগান্তি হয় না। কন্ডাক্টর ছেলেটা চ্যাঙড়া। এতক্ষন সব হজম করছিল। টিকিট এর পয়সা ফেরত দিচ্ছিল। আর থাকতে না পেরে বলল, আরে দাদা আপনিও তো বেড়িয়েছেন বাড়িথেকে। কোনো সিওরিটি আছে আপনি গন্তব্যে পৌছাবেন কি না?

আর কথা না বাড়িয়ে, বাস থেকে নেমে অন্য একটা ভিড় বাসে উঠলেন ব্রজেন বাবু। আজ টাইমের মধ্যে পৌছোতেই হবে। ঘাম হচ্ছে খুব। শরীর টা কেমন যেন অস্থির লাগছে। বমিভাব আসছে ভিড়ের মধ্যে। বুকের ভিতর একটা ভীষণ চাপ অনুভব করছেন। চ্যাঙড়া কন্ডাক্টর ছেলে টার কথা মনে এল, আপনি যে গন্তব্যে পৌছবেন তার কোনো সিওরিটি আছে?

কারা যেন চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিল। কানে ভেসে এল কারা যেন বলাবলি করছে, অসুস্থ শরীর নিয়ে কেন যে এই লোকগুলো বাড়ি থেকে বেরোয়?

ব্রজেন বাবুর মোবাইল ফোন থেকেই একটা অচেনা কণ্ঠস্বর মিত্রা কে দুঃসংবাদটা দিল। তখন বাজে সকাল সাড়ে দশটা।

সৌমিক মুখোপাধ্যায়
২৪ এপ্রিল ২০১৮

লোডশেডিং

আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাষ ছিলই।  দুপুর হতে না হতে আকাশ কালো করে এল।

সুমিত আজ আর দেরি না করে অফিস থেকে বেড়িয়ে পড়ল বিকেল বিকেল। অন্যদিন বেশ কিছুটা সময় অফিসে থাকতে হয় কাজের চাপে। কিন্তু আজ যা ওয়েদার, তাতে বাড়ি ফিরতে বেশ চাপ আছে মনে হয়।

বাইরে বেড়িয়েই মনে পড়ল আজ তো ইন্ডিয়ার খেলা আছে টি টোয়েন্টি। যাক বাড়ি ফিরে জমিয়ে খেলা দেখা যাবে। বাড়িতে জয়িতা কে ফোন করে বলল আজ খিচুড়ি করতে আর সাথে ডিম ভাজা।

এদিকে যত সময় যাচ্ছে ওয়েদার অত্যন্ত খারাপ হচ্ছে। সুমিত একটা ওলা পেয়ে গেল সহজেই। কিছুটা নিশ্চিন্ত। তুমুল ঝড় শুরু হল। সাথে বাজ পড়া আর মুশলধারায় বৃষ্টি। প্রচন্ড দূর্যোগ।

সন্ধ্যা বেলার মধ্যেই বাড়ি ফিরে এল। কিন্তু চারদিকে জল থইথই করছে। লোডশেডিং হয়ে গেছে প্রায় এক ঘন্টা হতে চলল। এই অবস্থায় কখন যে  আলো আসবে কোন ঠিক নেই। মোবাইল ফোন এর চার্জ ও প্রায় শেষ।

বাড়িতে মা এই সময়টা রোজ বাংলা সিরিয়াল দেখে। লোডশেডিং এর ফলে আজ টিভি বন্ধ। জয়িতা ঘরকন্নার কাজ সামলায়। আর সামলায় বুবলাই কে। ওদের সাত বছরের সন্তান। সবাই ব্যস্ত। শুধু রাতে খাবার টেবিলেই যেটুকু কথা হয়। সবাই যে যার মত নিজের নিজের কক্ষে বাস করে আর পাঁচটা সুখী পরিবার এর মতন।

ঘরে হারিকেন এর পাট চুকেছে বহু বছর হল। এখন বাতিই ভরসা। আগে সন্ধ্যা নামলেই আলো চলে যেত। সেই সব দিন গুলো তে হারিকেন এর যত্ন একটা রোজকার কাজ ছিল সব বাড়িতেই। সলতে গুলো কাচি  দিয়ে সমান ভাবে কাটা, কাচ পরিস্কার করা ইত্যাদি। সেসব পাট উঠে গেছে বহুদিন হল।

পাড়ার দোকান থেকে গোটা চারেক বাতি এনে রাখল সুমিত।কে জানে কখন আলো আসবে? মনে পড়ল, ছোট বেলায় আলো চলে গেলে বলা হত জ্যোতি বাবু চলে গেলেন। আর আলো এলেই জ্যোতি বাবু আসতেন।

ধুত্তোর কিছুই ভাল লাগছে না। খেলা দেখা মাটি। মোবাইল ও সুইচ অফ। বাইরে বৃষ্টি ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

মায়ের ঘরে মা গুন গুন করে বানী জয়রাম এর একটা গান গাইছিল। মায়ের পাশে বসে সুমিতও গলা মেলাল কত্ত বছর পর। বুবলাই ও জয়িতাও চলে এল ঘরে। আজ পড়ার ছুটি। বুবলাইয়ের ছড়া, জয়িতার আবৃত্তি। মায়ের মুখে ভুতের গল্প। কতকিছু আনন্দ ফিরে এল আজ। কোথা দিয়ে যে সময় টা কেটে গেল নিমেষে। কত দিন পড় আজ সবাই একসাথে, একমনে গান, গল্প, প্রান খুলে আড্ডা। আর সব শেষে খিচুড়ি। সেই পুরোনো স্বাদ।

বাইরে দুর্যোগ টা কমেছে।
রাত এগারো টা নাগাদ আলো এল। সবাইকে চমকে দিয়ে হাততালি দিয়ে বুবলাই বলে উঠল জ্যোতি বাবু এসে গেছে, জ্যোতি বাবু এসে গেছে।

আচ্ছা, মাঝে মাঝে লোডশেডিং হয় না কেন??



সৌমিক মুখোপাধ্যায়
২২ এপ্রিল ২০১৮, রোববার

তুবড়ি

কালিপুজোর সময়টা এলেই রতন পাড়ার হিরো হয়ে ওঠে। নাহলে বছরের অন্য সময়ে কেউ তাকে পাত্তাও দেয়না। দেবেই বা কেনো?  ছেলেবেলায় বাবা কে হারিয়েছে। আর মা লোকের বাড়ি বাসন মেজে কোন মতে কষ্টে দিন গুজরান করেছেন। লেখাপড়া শেখার সু্যোগ কখনও হয়নি। 
বছর দশেক আগে মা'ও চলে গেছে দুদিন এর জ্ব্ররে ভুগে।

পাড়ার মোড়ের সাইকেল এর দোকানে হেল্পার এর কাজ করে দিন কাটে আর রাতে সস্তা মদের নেশা। তাই সকলে তাকে এড়িয়ে চলে।

কিন্তু রতনের হাতে তুবড়ি কথা বলে। দুগগা পুজো শেষ হবার সাথে সাথেই পাড়ার ভদ্র লোকেরা ওর আশে পাশে ঘুরঘুর করে। বাড়ির জন্য তুবড়ির বায়না নিয়ে। এইসময় রতনের খাতিরই আলাদা। সে কাউকে ফিরিয়ে দিতে চায় না। যতটা সম্ভব সকল কে খুশি করে। যা টাকা পায়, তা দিয়ে রাতের বেলা নেশা করে।
কেউ তো কিছু বলার নেই ওকে।

দে বাড়ির ছোট মেয়ে রুমা রতনেরই বয়সি। ছোট্ট থেকেই দেখছে তাকে। লক্ষী প্রতিমার মত মুখ। আর গুনে সরস্বতী। ওকে দেখলে রতন এর যে ঠিক কি রকম অনুভুতি হয় তা বলে বোঝানো অসম্ভব। কত দিন ভেবেছে যে সবাই তো আসে ওর কাছে তুবড়ির বায়না নিয়ে কিন্তু ওই বাড়ির কেউ আসে না কেন। সেরা তুবড়িটা তাহলে বানিয়ে দেখিয়ে দিত রুমা'কে।

রতন এর স্বপ্ন আর পুরন হয় না। বছর ছয়েক আগে রুমার বিয়ে হয় কলকাতার এক ডাক্তারবাবু'র সাথে। পাড়াশুদ্ধ লোক খেতে গেছিল দে বাড়িতে। রতন কেও নেমন্তন্ন করেছিল রুমার বাবা। পাড়ার সকলের মতন। কিন্তু রতন যায় নি, যেতে মন চায় নি। ওই দিন সকাল বেলা পাড়ার মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়েছিল রতন। কেন কে জানে? আর ওই রাতে নেশাও করেছিল খুব।

এইবছর নিজের চোখ কে রতন নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। রুমা নিজে তুবড়ির বায়না নিয়ে এল রতনে'র কাছে। সাথে ওর ছোট্ট মেয়েটাকেও নিয়ে এসেছিল। যেমনি মা তেমনি মেয়ে। যেন পুতুল। এবছর আর তুবড়ির বেশি বরাত নিল না। সব মন প্রান দিয়ে তার স্বপ্ন পুরন করতে লাগল। এমন তুবড়ি বানাবো এবার, মুগ্ধ করে দেব রুমাকে।

কালিপুজোর দিন দুয়েক আগেই রুমাদের বাড়ি গিয়ে সব তুবড়ি পৌছে দিয়ে এল রতন।

এত আনন্দ জীবনে পায় নি সে। আজ ওর স্বপ্ন পুরনের দিন। ভাবতে লাগল যে ওর তুবড়ি জ্বালানোর পর রুমা'র মুখের প্রশান্তি র ছবি।

দুঃসংবাদ টা এসে আছড়ে পড়ল কালিপুজোর পরের দিন সক্কাল বেলা। খবর এল দে বাড়ি তে গতরাতে তুবড়ি ফেটে রুমা'র মুখ পুরো ঝলসে গেছে। কলকাতার এক নামী নার্সিংহোম এ ভরতি করা হয়েছে তাকে। নিতান্তই দুর্ঘটনা। কেউ একবার এর জন্য রতন কে দোষারোপও করে নি। কিন্তু এক অব্যক্ত যন্ত্রনা কূড়ে খেতে লাগল তাকে।
 
ভাইফোঁটা র দিন সকালে রতন এর ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ টা রেল লাইনের ধার থেকে সনাক্ত করল রেল পুলিস।



সৌমিক মুখোপাধ্যায়
২০।০৪।২০১৮

অভিভাবক

বেশ কয়েক বছর হল, এখন আর কচি কচি ডাল পালাগুলো আমার খুব একটা ধারে কাছে আসেনা। সেই যেদিন থেকে আমার পাতা গুলো হলুদ হতে শুরু করেছিল, ডাল গুলো শুকিয়ে আসছিল। নেহাত মানুষের মত ওরা দূরে সরিয়ে দিতে পারে না তো তাই গাছের একটা পরিত্বক্ত অংশ হিসেবেই দিন কেটে যাচ্ছিল আমার। আমিও মায়া ত্যাগ করছিলাম ধীরে ধীরে। 

গত কিছুদিন হল ছোট্ট চড়াই টা আমারই একটা ডালে বাসা তৈরি করেছিল ডিম পাড়বে বলে। আনন্দে মন ভরে উঠছিল আমার। বেশ আনন্দে ছিলাম এই কদিন। সখ্যতা গড়ে উঠেছিল চড়াইটার পরিবার এর সাথে। ওদের আর কি দোষ? ও তো আর জানে না যে যেখানে ও বাসা বাঁধছে তার মরন আগত প্রায়। কত সুখ দুখখের কথা হত আমাদের।

দিন সাতেক আগে চারটি ডিম পেড়েছিল মা চড়াই। ডিম তো নয়, যেন এক আকাশ মায়া। তারপর থেকেই ক্রমাগত তা দিয়ে বসে থাকা। মায়ের স্নেহ বলে কথা। তারপর ছানাদের ফুটে বেড়ানো। আমার পরিত্বক্ত ডালে নতুন জীবনের উৎসব।

কালকের নিষ্ঠুর কালবৈশাখী  ঝড়টা সব লণ্ডভণ্ড  করে দিল। আমারতো সময় হয়েই এসেছিল। দমকা হাওয়ায় আমি ভেঙে পড়লাম চড়াইয়ের বাসা টাকে সাথে নিয়ে। সাথে চার চারটি ফুটফুটে ছানা।

আমার শুকনো ডাল ও হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা দিয়ে আঁকড়ে ছিলাম বাসাটাকে। কিছুতেই হার মানি নি। একটা ছানার গায়েও আচর লাগতে দিই নি। ঝড় থামার পর রাতের অন্ধকারে চারটি ছানাকে নিয়ে সারারাত বসে পাহারা দিল বাবা ও মা চড়াই। ভোরের আলো ফোটার সাথেই ওরা আশ্র‍য় নিল মিত্তির বাড়ির ঘুলঘুলিতে। ওদের নতুন বাসায়।

আজ যখন সকাল বেলা মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা আমার ডালপালা গুলো কূড়িয়ে নিয়ে গেলো, অনেক টা দূর অবধি ছোট্ট চড়াই টা গেল আমার সাথে। আমাকে শেষ বিদায় জানাতে। 

ভাল থাকিস রে বিচ্ছু গুলো। তোদের জন্য এক আকাশ ভালবাসা ও আদর রইল।


সৌমিক মুখোপাধ্যায়।
এপ্রিল ১৮, ২০১৮। বুধবার।

দুঃসময়

সত্যি কি আমাদের কিছু আসে যায়? সন্ত্রাসে মরে সেনা মন্ত্রীরা করে হায় হায়। সত্যি কি আমাদের কিছু আসে যায়? মৃত সেনার ছবি খবরের পাতায় পাতায়। ...