বছরের এই সময়টাতেই কৃশ্নচূড়া গাছ গুলোতে রঙ লাগে। হালকা করে মাথার ওপর পাখা চলে। সোয়েটার, চাদর গুলোকে যত্ন করে ন্যাপথলিন সহযোগে আলমারি তে চালান করা হয়। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে কপালে ও সারা শরীরে। কোকিল জানান দেয় বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
ঠিক সাত বছর আগে ফেব্রুয়ারি মাসের পঁচিশ তারিখ টা ছিল শনিবার। হ্যা ঠিকই ধরেছেন দুহাজার বারোর কথা বলছি। শনিবার আমার অফিস ছুটি থাকার কারনে বাড়ির কাজকর্মেই কেটে গেল সকাল টা। আমি ও সীমন্তিনী (আমার স্ত্রী) একটু বেড়িয়েছিলাম টুকিটাকি বাজার করতে ঘন্টা খানেকের জন্য। মা বাড়িতেই ছিল। মেয়ে তখন ইস্কুলে। ইস্কুল বাসে ফিরবে বিকেলে তিনটে নাগাদ। আর বাবার ফেরা বিকেল বেলা।
আমরা বাড়ি ফিরে স্নান করে খেতে বসার আগেই ফোন এল বাবার। বলল লাঞ্চ করে গাড়িতে উঠছে। বিকেলবেলার আগেই বাড়ী পৌছে যাবে। বিকেলের চা টা খাওয়া হবে একসাথেই।
খাওয়া সেরে দুপুর আড়াইটে নাগাদ খবরের কাগজ টায় চোখ বোলাচ্ছিলাম। দিনটা চলছিল বেশ দুলকি চালে। মার মোবাইলে যখন ফোনটা এল ঘড়িতে তখন পৌনে তিনটে ।
মা আমাকে ফোন টা দিয়ে বলল দেখ তো কোনো থানা থেকে ফোন করছে। কি বলছে ফোনে কিছুই বুঝছি না। মায়ের সারাটা শরীরে কাঁপুনি। কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে তার।
আমি ফোনটা হাতে নিতেই ওপারের কন্ঠ বললেন উলুবেড়িয়া থানা থেকে ওসি বলছেন। এখুনি যেন আমরা চলে আসি থানায়। একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছে। ফোন নাম্বারটা উনি পেয়েছেন যাত্রীর পকেট থেকে।
বাবার মোবাইল ফোন ছিল না। একদিন আগেই যাদের সাথে গেছিল বেড়াতে তাদের একটা নম্বরে বহুবার ফোন করেও পেলাম না। সুইচ অফ।
আমার নিজের ইন্দ্রিয় গুলো কোন কাজ করছিল না মিনিট খানেকের জন্য। সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছিল। মা এবং আমার স্ত্রীকে দেখলাম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সম্বিত ফিরে পেলাম। বসে থাকার সময় নেই এখন।
একটা গাড়ি নিয়ে আমি ও জ্যাঠতুতো দাদা ছুটে গেলাম উলুবেড়িয়া র উদ্দেশ্যে। পথ টা মনে হচ্ছিল যেন অন্তহীন।
থানায় পৌছাতে ওসি বললেন উলুবেড়িয়া হাসপাতালে যেতে। ওখানেই নাকি পাবো বাবাকে।
কাছেই হাসপাতাল। ছুটলাম বুকে অনেকে আশা নিয়ে। স্থানীয় জনতা থিকথিক করছে হাসপাতালের বাইরে। আমরা পৌছাতেই স্থানীয় নেতা গোছের কিছু লোক পৌছে দিল আমার বাবার কাছে। সাদা চাদরে মাথা থেকে পা অব্ধি সারাটা শরীর মোড়া। হাসপাতাল সুপারের তত্বাবধানে ওই দেহ টা শনাক্ত করতে হবে। স্বীকার করছি, চুড়ান্ত স্বার্থপর হয়েছিলাম আমি ওই একটি বার। ঈশ্বর কে ডাকছিলাম চাদর সরালে যেন অন্য কোন মুখ দেখি। ঈশ্বর কথা রাখেননি। এরপর আইনগত সমস্ত জটিলতা। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আমার বাবা তখন বডি হয়ে লাশকাটা ঘরে শায়িত।
চার বন্ধু যারা মর্নিং ওয়াকের সাথী ছিলেন তারা একসাথেই চলে গেলেন। আমাদের পরিবারের কাছে এই চলে যাওয়াটা অনেকটা হারিয়ে যাওয়ার মতন। সত্যি বলছি আজও কেমন ঘোরের মধ্যে থাকি যখন দিনটার কথা মনে পড়ে।
ওই দিন সড়ক দুর্ঘটনায় একসাথে প্রান হারিয়েছিলেন মর্নিং ওয়াকের চার অতি সজ্জন বন্ধু, আমার বাবা সমর মুখোপাধ্যায়, তাপস বিশ্বাস, শ্যামল দাশ ও সমীর বাগ। সকলেরই বয়স ছিল ষাট থেকে সত্তরের ভিতর। প্রত্যেকেই স্থানীয় বাসিন্দা। সেদিন শোকাচ্ছন্ন হয়েছিল আরিয়াদহ।
বাবা, যেখানেই থাকো। ভাল থেকো। চিরশান্তিতে থেকো।
মর্নিং ওয়াকের কাকুরা, আপনারাও ভাল থাকবেন। চিরশান্তি তে থাকবেন।
প্রনাম।
~ সৌমিক মুখোপাধ্যায়
~ ২৪ শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯
ঠিক সাত বছর আগে ফেব্রুয়ারি মাসের পঁচিশ তারিখ টা ছিল শনিবার। হ্যা ঠিকই ধরেছেন দুহাজার বারোর কথা বলছি। শনিবার আমার অফিস ছুটি থাকার কারনে বাড়ির কাজকর্মেই কেটে গেল সকাল টা। আমি ও সীমন্তিনী (আমার স্ত্রী) একটু বেড়িয়েছিলাম টুকিটাকি বাজার করতে ঘন্টা খানেকের জন্য। মা বাড়িতেই ছিল। মেয়ে তখন ইস্কুলে। ইস্কুল বাসে ফিরবে বিকেলে তিনটে নাগাদ। আর বাবার ফেরা বিকেল বেলা।
আমরা বাড়ি ফিরে স্নান করে খেতে বসার আগেই ফোন এল বাবার। বলল লাঞ্চ করে গাড়িতে উঠছে। বিকেলবেলার আগেই বাড়ী পৌছে যাবে। বিকেলের চা টা খাওয়া হবে একসাথেই।
খাওয়া সেরে দুপুর আড়াইটে নাগাদ খবরের কাগজ টায় চোখ বোলাচ্ছিলাম। দিনটা চলছিল বেশ দুলকি চালে। মার মোবাইলে যখন ফোনটা এল ঘড়িতে তখন পৌনে তিনটে ।
মা আমাকে ফোন টা দিয়ে বলল দেখ তো কোনো থানা থেকে ফোন করছে। কি বলছে ফোনে কিছুই বুঝছি না। মায়ের সারাটা শরীরে কাঁপুনি। কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে তার।
আমি ফোনটা হাতে নিতেই ওপারের কন্ঠ বললেন উলুবেড়িয়া থানা থেকে ওসি বলছেন। এখুনি যেন আমরা চলে আসি থানায়। একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছে। ফোন নাম্বারটা উনি পেয়েছেন যাত্রীর পকেট থেকে।
বাবার মোবাইল ফোন ছিল না। একদিন আগেই যাদের সাথে গেছিল বেড়াতে তাদের একটা নম্বরে বহুবার ফোন করেও পেলাম না। সুইচ অফ।
আমার নিজের ইন্দ্রিয় গুলো কোন কাজ করছিল না মিনিট খানেকের জন্য। সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছিল। মা এবং আমার স্ত্রীকে দেখলাম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সম্বিত ফিরে পেলাম। বসে থাকার সময় নেই এখন।
একটা গাড়ি নিয়ে আমি ও জ্যাঠতুতো দাদা ছুটে গেলাম উলুবেড়িয়া র উদ্দেশ্যে। পথ টা মনে হচ্ছিল যেন অন্তহীন।
থানায় পৌছাতে ওসি বললেন উলুবেড়িয়া হাসপাতালে যেতে। ওখানেই নাকি পাবো বাবাকে।
কাছেই হাসপাতাল। ছুটলাম বুকে অনেকে আশা নিয়ে। স্থানীয় জনতা থিকথিক করছে হাসপাতালের বাইরে। আমরা পৌছাতেই স্থানীয় নেতা গোছের কিছু লোক পৌছে দিল আমার বাবার কাছে। সাদা চাদরে মাথা থেকে পা অব্ধি সারাটা শরীর মোড়া। হাসপাতাল সুপারের তত্বাবধানে ওই দেহ টা শনাক্ত করতে হবে। স্বীকার করছি, চুড়ান্ত স্বার্থপর হয়েছিলাম আমি ওই একটি বার। ঈশ্বর কে ডাকছিলাম চাদর সরালে যেন অন্য কোন মুখ দেখি। ঈশ্বর কথা রাখেননি। এরপর আইনগত সমস্ত জটিলতা। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আমার বাবা তখন বডি হয়ে লাশকাটা ঘরে শায়িত।
চার বন্ধু যারা মর্নিং ওয়াকের সাথী ছিলেন তারা একসাথেই চলে গেলেন। আমাদের পরিবারের কাছে এই চলে যাওয়াটা অনেকটা হারিয়ে যাওয়ার মতন। সত্যি বলছি আজও কেমন ঘোরের মধ্যে থাকি যখন দিনটার কথা মনে পড়ে।
ওই দিন সড়ক দুর্ঘটনায় একসাথে প্রান হারিয়েছিলেন মর্নিং ওয়াকের চার অতি সজ্জন বন্ধু, আমার বাবা সমর মুখোপাধ্যায়, তাপস বিশ্বাস, শ্যামল দাশ ও সমীর বাগ। সকলেরই বয়স ছিল ষাট থেকে সত্তরের ভিতর। প্রত্যেকেই স্থানীয় বাসিন্দা। সেদিন শোকাচ্ছন্ন হয়েছিল আরিয়াদহ।
বাবা, যেখানেই থাকো। ভাল থেকো। চিরশান্তিতে থেকো।
মর্নিং ওয়াকের কাকুরা, আপনারাও ভাল থাকবেন। চিরশান্তি তে থাকবেন।
প্রনাম।
~ সৌমিক মুখোপাধ্যায়
~ ২৪ শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯
No comments:
Post a Comment